হবিগঞ্জ শহরের দানিয়ালপুরের দরিদ্র দিনমজুর মোহাম্মদ আলীর কন্যা। সমবয়সী আর দশ জন যখন লেখাপড়া করছিল তখন দারিদ্র্যের জন্য অনাহারে অর্ধাহারে দিনাতিপাত করতে হচ্ছিল তার। পাড়া প্রতিবেশীর অনেকেরই বিয়ের সানাই বাজলেও মেয়েকে বিয়ে দিবেন সেই সামর্থও ছিল না পিতার। আর ১০টা মেয়ের মত সংসার করার স্বপ্ন ছিল মাহিদার। অভাবকে জয় করে তার সেই স্বপ্ন পূরণ করে দিয়েছে হবিগঞ্জ পৌরসভার কন্যাদান অনুষ্ঠান। গতকাল বুধবার হবিগঞ্জ পৌরসভার উদ্যোগে পৌর এলাকার ১২ দরিদ্র কন্যার অভিভাবক হিসাবে দায়িত্ব নিয়ে এই কন্যাদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। দুপুরে ঘড়ির কাঁটা ১২টায় আসার আগেই পৌরসভার হল রুমে সারিবদ্ধভাবে ১২ কন্যা আসন নেয় তখন তাদের বিপরীত দিকে আসন নেয় ১০ বর। অনুষ্ঠান শুরুর পূর্বেই চলে আসে তাহেরা বেগমের বর নিজাম উদ্দিন। কিন্তু বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা যখন শেষ পর্যায়ে চলে আসে তখনও হাজির হননি মাহিদা বেগমের বর সাজন মিয়া। এ নিয়ে টেনশনের অন্ত ছিল না মাহিদার। অন্য ১১ কন্যা যখন কবুল বলা শেষ করে নতুন সংসারের আনন্দে বিভোর তখন রাজ্যের টেনশন মাহিদার মনে। এ সময় পৌরসভার কাউন্সিলর সালমা বেগম তাকে শান্তনা দেন। আকদ শেষে যখন মোনাজাত শুরু হবে তখনই চলে আসে সাজন মিয়া। মাহিদার মন থেকে কেটে যায় সকল হতাশা। মাহিদা বেগম পৌরসভার সৌজন্যে স্বপ্ন পূরণ করতে পেরে আনন্দিত। সে এখন পিছনের সকল হতাশা ভুলে সুন্দর ও পরিকল্পিত সংসার গড়ে তুলতে চায়।
পিতা রতন মিয়ার অকাল মৃত্যুর কারণে ৫ম শ্রেণীর বেশী লেখাপড়া করতে পারেনি হবিগঞ্জ সদর উপজেলার লস্করপুর গ্রামের সিএনজি অটোরিক্সা চালক আব্দুল আওয়াল। দারিদ্র্যের জন্য বিয়ে করার স্বপ্ন দেখতেও সে সাহস পায়নি। কিন্তু হবিগঞ্জ পৌরসভার কন্যাদান অনুষ্ঠান তার স্বপ্ন পূরণ করেছে। বিয়ে উপলক্ষে মঙ্গলবার তার গ্রামের বাড়িতে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়। পিতা না থাকায় নিজে লেখাপড়া না করতে পারলেও তার ইচ্ছা হল যদি আল্লাহ তাকে কোন সন্তান দেন তাহলে তাকে লেখাপড়া করাবে। সে দুটির বেশী সন্তান নিবে না বলেও জানায়। আব্দুল আওয়াল জানায়, সে কন্যা না দেখেই বিয়েতে রাজী হয়। তার অভিভাবকরা কন্যা দেখে বিয়েতে রাজী হয়েছেন।
হবিগঞ্জ পৌরসভা ২য় বারের ন্যায় এই কন্যাদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। গত বছর ৮ কন্যাকে বিয়ে দেয়া হয়েছিল। এ বছর বিয়ে দেয়া হয় ১২ জনকে।
হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আলহাজ্ব জি কে গউছ জানান, পৌরসভার পক্ষ থেকে সামাজিক দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে দরিদ্র কন্যাদায়গ্রস্থ পরিবারকে সহায়তা করতে এই আয়োজন। হবিগঞ্জ পৌরসভা সবসময় এ ধরনের ব্যাতিক্রমধর্মী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। কন্যাদান অনুষ্ঠানে প্রত্যেক দম্পতিকে নগদ ২০ হাজার টাকা, ১টি করে সেলাই মেশিনসহ বিভিন্ন উপহার সামগ্রী দেয়া হয়।
গতকাল সকাল ১০টা থেকে হবিগঞ্জ পৌরসভায় দেখা দেয় উৎসবের আমেজ। সাউন্ড বক্সে সানাই বাজতে থাকে উচ্চস্বরে। পৌরসভার একটি কক্ষে কনেদেরকে সাজানোর দায়িত্ব পালন করেন তরুণীরা। আরেকটি রুমে বরদেরকে সাজানো হয়। অতিথিরা যখন উপহার এবং মিষ্টি নিয়ে আসেন তখন তা গ্রহণ করেন পৌরসভার মেয়র জি কে গউছ। বেলা ১১টায় অনুষ্ঠানস্থলে হাজির হন জেলা প্রশাসক মোঃ জয়নাল আবেদীন, তার স্ত্রী লেডিস ক্লাব সভানেত্রী মিতা বেগমসহ শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। দুপুরে বর-কনেরা নির্ধারিত আসনে বসলে অতিথিবৃন্দ তাদের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেন। সাড়ে ১২টায় বিয়ের কাজ শুরু করেন কাজী মাওলানা জসিম উদ্দিন খান চৌধুরী। একে একে আকদ সম্পন্ন করার পর দোয়া করা হয়। পরে বর-কনে মালা বদল করেন। এরপর অতিথি ও নব-দম্পতিদেরকে আপ্যায়ন করা হয়। বর-কনের জন্য ১২টি সাগরানার ব্যবস্থা করা হয়। সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষে বরের কাছে কন্যা তুলে দেন পৌর মেয়র জি কে গউছ। অতিথিদের দেয়া উপহার সামগ্রী বন্টন করে সাথে দিয়ে দেন তিনি। সকলেই বিপুল পরিমাণ উপহার সামগ্রী পায়। গণবিয়ের দেনমোহন ৫০ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
হবিগঞ্জ শহরের গোসাইপুর এলাকার মোছাঃ শাবনুর আক্তার এই বিয়েতে খুবই আনন্দিত। তার বর রিপন মিয়াও হবিগঞ্জ শহরের কামড়াপুর এলাকার বাসিন্দা। পেশায় রাজমিস্ত্রী। দু’জনে মিলে সুন্দর পরিবার গড়ার স্বপ্ন তার। ১ মাস পূর্বে পারিবারিকভাবে দেখা বরের সাথেই বিয়ে হয় তার। বিয়েতে তার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে বলে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে সে। পৌর কর্তৃপক্ষের প্রতিও তার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
নবীগঞ্জের কৃষক পরিবারের সন্তান রুমেন মিয়া ঘটকের মাধ্যমে এই গণবিয়ের কথা জানতে পেরে রুজিনা আক্তারকে বিয়ে করেন। এখন তার স্বপন আয় রোজগার করে সুন্দর পরিবার গড়ে তোলার। নিজে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করলেও ভবিষ্যত প্রজন্মকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলাই তার লক্ষ্য।
হবিগঞ্জ পৌরসভার আয়োজনে বিয়ে হওয়া সকল কনের বসবাস পৌর এলাকায়। বরদের বাড়ি জেলার বিভিন্ন স্থানে। তবে জেলার বাইরে লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জের মোবারক হোসেনও এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিয়ে করেন নাতিরাবাদ এলাকার মোছাঃ অজুফা বেগমকে। অভাবের তাড়নায় কাজ করতে মোবারকের পরিবার আসে হবিগঞ্জে। বসবাস করতে থাকে নাতিরপুর এলাকায় এক বস্তিতে। অতীতের অভাব ভুলে এখন সে ভাল কাজও করতে পারছে। নতুন সংসারও পেয়েছে। সুখী দম্পতি হিসেবে আগামী দিনগুলো অতিবাহিত করার স্বপ্ন তার। পৌরসভার এই উদ্যোগ না থাকলে আদৌ বিয়ে করা সম্ভব হত কি-না সন্দেহ ছিল তার।
কন্যাদান অনুষ্ঠানের আহবায়ক হবিগঞ্জ পৌরসভার মহিলা কাউন্সিলর সালমা বেগম জানান, ১ম বার পৌরসভার কন্যাদান অনুষ্ঠান প্রশংসিত হওয়ায় এ বছর আরও বড় আকারে আয়োজনের উদ্যোগ নেয়া হয়। পৌর পরিষদ আগ্রহীদের তালিকা তৈরি করে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। দরিদ্র কন্যাদের অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে পৌরসভা। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আয়োজনটি সফল হয়েছে বলে তিনি জানান।
হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোঃ জয়নাল আবেদীন পৌরসভার উদ্যোগের প্রশংসা করেন এবং এ ধরনের উদ্যোগে প্রশাসন থেকে সহায়তার আশ্বাস দেন। তিনি সবাইকে পৌরসভার এই ভাল কাজকে অনুসরণের আহবান জানান।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস